
মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন দেশের গলার কাঁটা। তাদের ফেরত পাঠাতে দফায় দফায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও, তা কোনো কাজে আসেনি। সংকট নিরসনে খুব একটা তৎপরতা নেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের। ফলে আদৌ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কি-না, তা নিয়ে ধুয়াশার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন,মিয়ানমারের রাখাইনে এখনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। উল্টো দেশটিতে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা বেড়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের আয়োজনে দোহায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হওয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই চোখে পড়ছে না। কেন যেন কিছুই হচ্ছে না, ঘোলাটে লাগছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে কাজ করছে। টেকসই সমাধান বের করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
কূটনীতির বিষয়গুলো এমন যে সহজে ধরা যায় না। তাই সবাই বলছেন যে বিষয়টি কী চাপা পড়ে যাচ্ছে? বিষয়টি যাতে চাপা না পড়ে এবং টেকসই সমাধান আসে সে জন্য ঢাকার কূটনীতিকরা কাজ করছেন। প্রায় প্রতি মাসেই জেনেভা অথবা নিউইয়র্ক থেকে জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সেমিনার বা বৈঠক করছেন।
গত এপ্রিলে বিমসটেক বৈঠকের ফাঁকে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউর সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানের আলোচনা হয়েছে।
ওই আলোচনার পর মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এসে রোহিঙ্গাদের ভেরিফিকেশন এবং প্রত্যাবাসন ইস্যুতে কথা বলেছেন, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একটি বড় অগ্রগতি। নেপিডোতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎপরতায় গত ৩৩ মাসে রোহিঙ্গা ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
এ সময় বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎপরতায় প্রায় দেড় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ভেরিফিকেশনের কাজ শেষ করেছে মিয়ানমার। এর আগের ৩০ মাসেরও বেশি সময়ে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গার ভেরিফিকেশন করেছে মিয়ানমার। মূলত ২০২১ সালের পর থেকে বাংলাদেশ মিশনের তৎপরতায় মিয়ানমার ভেরিফিকেশন কার্যক্রম দ্রুত করছে।
বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত মন্তব্যটি ভবিষ্যতের জন্য একটি দলিল হয়ে থাকবে। মিয়ানমারের এই ভেরিফিকেশন কার্যক্রমে প্রচণ্ড গতি ফেরাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে সহযোগিতা চায়। ভেরিফিকেশন কার্যক্রমে গতি বাড়াতে ঢাকার কূটনীতিকরা নেপিডোর কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
নেপিডোর কূটনীতিকরা জানিয়েছেন যে, ভেরিফিকেশন কার্যক্রম দ্রুতগতিতে করার জন্য মিয়ানমারের কাছে প্রয়োজনীয় জনবল ও তহবিল নেই। তাই ভেরিফিকেশন খাতে চীন বা যুক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক বিশ্ব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে এই কার্যক্রম দ্রুত শেষ হবে।
সবশেষ গত সোমবার পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম এই ইস্যুতে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে এ ইস্যুতে কথা বলেছেন। চীনের সহযোগিতা চেয়েছেন।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত তারেক মো. আরিফুল ইসলাম গত ৪ জুলাই জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার জন্য বাংলাদেশ সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা এবং তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য দ্রুত একটি অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত দায়িত্ব।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমি হতাশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ইস্যুতে আগামী সেপ্টেম্বরে বিশ্বনেতাদের সমন্বয়ে এক সেমিনারের মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠার কথা বলেছেন।
কিন্তু এই আয়োজনের উদ্যোক্তা ঢাকা হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রস্তুতি বা কৌশলগত অবস্থান বা কোনো ওয়ার্কিং পেপার চোখে পড়েনি। বিষয়টি এখন ঘোলাটে মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রদূত খলিলুর রহমানকে যখন এই ইস্যুতে দায়িত্ব দেওয়া হলো তখন খুব এক্সাইটেট হয়েছিলাম যে ভালো কিছু হবে।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে খলিল সাহেবের বাস্তবতার বাইরে গিয়ে মন্তব্য শুনে অবাক হয়েছি। খলিল সাহেবের কথাগুলো গ্রাউন্ড রিয়েলিটির মধ্যে ছিল না। তিনি রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই নিয়ে যে তথ্য বলেছিলেন সেটিও পুরো পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পূর্ণ সঠিক ছিল না। পরবর্তী সময়ে তাকে আবার নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং এখন তিনি বাণিজ্য ইস্যুতে কাজ করছেন।
সবকিছু মিলে মনে হচ্ছে যে আমরা কী পথ হারালাম? গত রোজার ঈদে প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে রোহিঙ্গারা সামনের ঈদ তাদের মাতৃভূমিতে করবেন। এরপর কুরবানি ঈদও চলে গেল কিন্তু কিছুই আর চোখে পড়ছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশিরাই বেশি ভুক্তভোগী, তাই আমাদেরই মূল কাজ করতে হবে। কিন্তু কেন যেন কিছুই হচ্ছে না, ঘোলাটে লাগছে।
অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বলেন, আমরা বর্তমানে ট্রানজিশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যতটুকু বুঝতে পারি যে বর্তমান সরকারের এ বিষয়ে ভালো কিছু করার ইচ্ছা আছে কিন্তু বিষয়টি অনেক জটিল। আগামী সেপ্টেম্বরে এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার কথা আগেই জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদে সমাধান ও তহবিল জোগাড় গুরুত্ব পাবে।
এই ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের স্বদিচ্ছা সবার আগে। বিষয়টি এতই জটিল যে দ্রুত সমাধান করা কঠিন। এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং নির্বাচিত সরকার। এই ইস্যুটি যাতে হারিয়ে না যায় এ জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে সজাগ রাখতে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ মিশন একাধিক সেমিনার বা এ সংক্রান্ত কর্ম উদ্যোগ নিচ্ছে কিন্তু তা যথেষ্ট না।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে যে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির থেকে অনেকে যোগ দিচ্ছে, বিষয়টি উদ্বেগজনক। দ্রুত সমাধানের জন্য রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে আপাতত স্থানান্তর করা যায়।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে আঞ্চলিক পর্যায়ে সম্মেলন করা প্রয়োজন যা আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। পরিতাপের বিষয় হলো কোনো সরকারই তা আমলে নিচ্ছে না।
জানা গেছে, বর্তমানে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থানরত নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখ ৫ হাজার ৫২০ জন, যার মধ্যে ২ লাখ ৪ হাজার ২৭৪ পরিবার রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু, ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক, ৪ শতাংশ বয়স্ক রয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪ হাজার ৯২ হাজার ৭০৫ জন পুরুষ (৪৯ শতাংশ), ৫ লাখ ১২ হাজার ৮১৫ জন মহিলা (৫১ শতাংশ) রয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বছর আনুমানিক ৩০ হাজার নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করে।
পাঠকের মতামত